মাগুরা প্রতিনিধিঃ মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামে নবগঙ্গা নদীর তীরে স্কুলটির অবস্থান। পাশে গঙ্গারামপুর ও নহাটায় রয়েছে বড় দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বড় স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্যেও জয়রামপুর সপ্তগ্রাম সম্মিলনী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় দুই শতাধিক। এর মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ১২৫, বাকি সবাই ছেলে।

২২ বছর বেতন ছাড়াই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন মোঃ জাফর মৃধা। পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিতে ১৯৯৮ সালে স্থানীয়দের সহায়তায় নিজ এলাকায় গড়ে তোলেন জয়রামপুর সপ্তগ্রাম সম্মিলনী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যদিও নিম্ন মাধ্যমিক তারপরও ৯ম ও ১০ ম শ্রেনীর কার্যক্রম চলে শুরু থেকেই অন্য স্কুলে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে।সেই ১৯৯৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বেতন ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন তিনি।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিদ্যালয়টি ‘গরিবের স্কুল’ বলে পরিচিতি লাভ করেছে এলাকায়।

প্রধান শিক্ষক জাফর মৃধা বলেন,স্কুলের সাধারণ অবকাঠামো ও জীর্ণদশার কারণে বিত্তশালীদের সন্তানেরা এখানে পড়তে চায় না। বেঞ্চ, টেবিল, শ্রেণিকক্ষ প্রায় সবই ভাঙাচোরা। এলাকার হৃদয়বান কিছু মানুষের সহযোগিতায় মাঝেমধ্যে এগুলা ঠিক হয়। নামেমাত্র বেতন দিতে হয় বলে হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাই স্কুলটিতে ভর্তি হয়।
এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ ভ্যানচালক, রিক্সা চালক, দিন মজুর অথবা নিম্ন আয়ের মানুষের ছেলে মেয়ে। তাদের নিকট থেকে পাওয়া অল্পকিছু টাকায় স্কুলটির পরিচালনা ব্যয়, ছয়জন শিক্ষককে সামান্য সম্মানি দেয়া হয়। এভাবেই চলছে প্রায় দুই যুগ ।

জয়রামপুর গ্রামটি স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে।লোকমুখে জানা যায়, ১৯৭১ সালে এখানে পাকিস্তানিদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ হয়েছিল।ঐ যুদ্ধে আবির হোসেন নামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রনাঙ্গনেই শহীদ হন।তাঁর স্মরণে স্কুলের পাশেই তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ।এলাকার শিশুদের এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন থেকে নহাটা ইউনিয়ন পরিষদ এর তৎকালীন পানিঘাটা ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বর মোঃ ওবায়দুর রহমান এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে গড়ে তোলেন স্কুলটি। কিন্তু ২২ বছরেও সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা মেলেনি।

প্রধান শিক্ষক জাফর মৃধা আরও বলেন, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল অত্যন্ত ভালো।গত তিন বছরে পাসের হার ৯৩ শতাংশ। স্থানীয় এমপি ড.শ্রী বীরেন শিকদার মহোদয় একবার এমপিওভুক্তির কাজ প্রায় চুড়ান্ত করলেও কিছু কারিগরি ত্রুটির কারনে বিষয়টি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এলাকায় বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষের বসবাস। তাই শক্ত কোনো সুপারিশও জোটেনি স্কুলটির জন্য।

বিনা বেতনে পড়িয়ে কিভাবে চলে শিক্ষকদের পরিবার- এমন প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক বিষণ্ন কণ্ঠে বলেন, কেও কৃষি জমি চাষবাস করে কোনোরকমে ছোট পরিবার নিয়ে চলে।কেও ছোটখাটো অন্যান্য কাজ করে কোনমতে সংসার টিকে রেখেছে।আমি চাই স্কুলটি এমপিওভুক্ত হোক। তাহলে পিছিয়ে পড়া অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়তে পারবে। শিক্ষকবৃন্দ বেতন পাবেন। এলাকাটি আর পিছিয়ে থাকবে না।

স্থানীয় জামাল মোল্লার মেয়ে পড়ে এই স্কুলে। পেশায় কৃষক জামাল বলেন, খুব ভালো পড়ান স্যারেরা। কিন্তু উনারা নিজেরা খুব কষ্টে থাকেন। এটা আমাদের খুবই কষ্ট দেয়।
আরেক অভিভাবক আকবর বিশ্বাস বলেন, গরিব বলে ছেলেকে অন্য স্কুলে পড়াতে পারেননি। তবে এখানে শিক্ষকেরা খুব ভালো পড়ান।
করোনাকালীন সরকারি প্রণোদনার কিছু অর্থ পেয়েছিলেন শিক্ষকরা। তবে দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে সব শিক্ষকের।
জাফর মৃধা বলেন, আয়ের উৎস না থাকলে স্কুলটি চালানো কষ্ট হয়ে যাবে। ২২ বছর টেনে আনতে কষ্ট হয়েছে ঠিক। কিন্তু এই করোনাকালে ভার আর সহ্য করা যাচ্ছে না।

মাগুরা জেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী পরিদর্শক মাজেদ উর রহমান বলেন, ‘স্কুলটির ফল সন্তোষজনক। বেশকিছু শিক্ষার্থী আছে বলে আমরা জানি। ওই এলাকায় অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। স্কুলটি তাদের সন্তানদের পাঠদানে সহায়তা করছে। এটা প্রশংসনীয়। এমপিওভুক্তির বিষয়ে তারা আবেদন করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

স্কুলটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সম্মানিত সভাপতি, নহাটা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল সিদ্দিকী লিটন সাহেব এ বিষয়ে বলেন,অনেক দিন ধরে স্কুলটি অবহেলায় পড়ে আছে। স্থানীয় এমপি মহোদয় একবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কিছু সমস্যার কারনে হয়নি।মাননীয় এমপি ড. শ্রী বীরেন শিকদার মহোদয় আবারও চেষ্টা করবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।তাছাড়া তিনি এই স্কুলে একটি ভবণও এবছর দিবেন বলে প্রতিশ্রতি দিয়েছেন এবং তার অফিশিয়াল কাজ কর্ম চলছে।